Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা

বঙ্গবন্ধুর কৃষি উন্নয়ন ভাবনা
ড. জাহাঙ্গীর আলম

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এ দেশের কৃষকরা ছিলেন শোষিত। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল কৃষকদের প্রতিকূলে। ফলে উৎপাদনে তাদের উৎসাহ ছিল কম। প্রতি ইউনিট উৎপাদন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নমানের। ফলে এ দেশ ছিল ঐতিহাসিকভাবে একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে এ দেশে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষি উৎপাদন। প্রয়োজনীয় বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে কৃষিপণ্যের চলাচল ও বাজারজাত দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ১৯৭২ সালে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার চাল নাই, ডাল নাই, রাস্তা নাই, রেলওয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে, সব শেষ করে দিয়ে গেছে ফেরাউনের দল।’ ফলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ।


বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে। তখন থেকেই কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ধারণা উৎসাহিত করা হয়। সহজ ও সুলভ করা হয় কৃষি উপকরণ সরবরাহ। পানি সেচ সম্প্রসারিত করা হয়। অনেকটা নিশ্চিত করা হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায়সংগত মূল্য। তাতে উৎপাদনে আগ্রহী হয় কৃষকগণ। বেড়ে যায় কৃষির সার্বিক উৎপাদন। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যের উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। পরনির্ভরতা খুবই কম। চাল উৎপাদনে এখন আমরা উদ্বৃত্ত। এক্ষেত্রে ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে আমাদের স্থান সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। ১৯৭২ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি টন। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে চার কোটি টনেরও ওপরে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। এ সময় সারা বিশ্বের গড় উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল সারা বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে ওপরে। চিরকালের খাদ্য ঘাটতি, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগের কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই বিপুল উন্নয়ন। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।


বঙ্গবন্ধু কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন তাদের মঙ্গল নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু ওই নির্বাচনী জোটের অংশীদার ছিলেন। প্রার্থী হন কোটালিপাড়া-গোপালগঞ্জ আসনে। ওই জোটের ২১ দফা কর্মসূচির মধ্যে প্রধান ছয়টি দফাই ছিল কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য নিবেদিত।
উল্লিখিত একুশ দফার ছয় দফার মধ্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। খাজনা হ্রাস ও সার্টিফিকেট কেইস রহিত করার অঙ্গীকার ছিল। বাংলার পাটচাষিদের বঞ্চনার কথা বিবেচনা করে পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। খাল খনন ও সেচের মাধ্যমে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। সর্বোপরি দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জোটের অন্যতম একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ওই নির্বাচন প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম একজন প্রণেতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর এর শরিক দল আওয়ামী লীগ থেকে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অতঃপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তিনি পরবর্তী কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এভাবে তিনি পঞ্চাশের দশকে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষকদের মঙ্গলের জন্য কাজ করার সুযোগ পান।


পাকিস্তান আমলে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আলাপচারিতা ও বক্তৃতার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রামীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। তার ’৭০ সালের ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে তিনি সেই চিত্রের কিছুটা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলার বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। জনগণকে সেই অনাহার থেকে রক্ষা করতে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে যেক্ষেত্রে প্রতি মাসে মোটা চালের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে সে চালের দাম ছিল গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাংলায় যে আটার দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের সরিষার তেলের দাম ছিল আড়াই টাকা, বাংলাদেশে তার দাম ছিল ৫ টাকা। এসব উদাহরণ টেনে তিনি বাংলাদেশের কৃষক ও গ্রামীণ মানুষের দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরেছেন জাতির সামনে। সেই সঙ্গে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে সামন্ত প্রভুদের অফুরন্ত সম্পদ অর্জনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং গরিব কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। ২৮ অক্টোবর প্রদত্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সামন্ত প্রভুরা রাজকীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে। তারা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তাদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকদের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে।’ ওই ভাষণে তিনি ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ ও বকেয়া খাজনা মওকুফের অঙ্গীকার করেন। পাটচাষিদের সুরক্ষার জন্য তিনি পাট ব্যবসা জাতীয়করণ ও পাট গবেষণা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি কৃষি বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক বলে দিকনির্দেশনা দেন।


’৭০-এর ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। তারপর তিনি প্রদান করেন তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা। তাতে তিনি কৃষি ও কৃষকের স্বার্থের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। আইয়ুবি আমলে বাস্তুহারা হয়েছে বাংলার মানুষ। সরকারের খাসজমি বণ্টন করা হয়েছে ভূঁইওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে এদের কাছ থেকে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। ভবিষ্যতে সব খাসজমি বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’


’৭০এর নির্বাচনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনায় আগ্রহী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের সাধারণ কৃষক, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ও শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের অভিপ্রায় ছিল তাঁর, কিন্তু পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য থেকে তিনি তা করার সুযোগ পাননি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি একের পর এক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেন। তন্মধ্যে দেশের কৃষিক্ষেত্রে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম ছিল ভূমি সংস্কার। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ’৯৬ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির সব খাজনা রহিত করেন। তাতে বছরে প্রায় ৭ দশমিক ৫৪ কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। রাষ্ট্রপতির ৯৮ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবার প্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। তাতে ৫ হাজার ৩৭১টি পরিবার থেকে ৭৬ হাজার ৭১২ একর জমি সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ওই জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে। তাছাড়া আশ্রয়হীনদের জন্য গড়ে তুলেন গুচ্ছগ্রাম। নতুন জেগে ওঠা চর ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করেন বিনামূল্যে। গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের বাঁচানোর জন্য তাদের রেশনের আওতায় নিয়ে আসেন।


বাংলাদেশের কৃষকদের ঋণগ্রস্ততার কথা বঙ্গবন্ধু ভালোভাবে জানতেন। তাদের আর্থিক দুর্দশা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। তাই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পাকিস্তান আমলে নেয়া কৃষকদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। তাদের বিরুদ্ধে করা ১০ লক্ষ সার্টিফিকেট কেইস তিনি প্রত্যাহার করে নেন। উচ্চসুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য এবং তাদের কাছে অবাধে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। গ্রামবাংলার কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করা এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বঙ্গবন্ধুর সরাসরি তত্ত্বাবধানে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লবের বিকাশের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।


বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না।’ এ কৃষি বিপ্লবে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি কৃষি উপকরণের ওপর উদার সহায়তা প্রদান করেন। রাসায়নিক সার বিতরণের ব্যবস্থা করেন প্রায় অর্ধেক মূল্যে। ১৯৭২ সালে সের প্রতি (প্রতি কেজি প্রায়) ইউরিয়া সারের মূল্য ছিল আট আনা (২০ টাকা মণ), টিএসপি সারের মূল্য ছিল ৬ আনা (১৫ টাকা মণ) এবং এমওপি সারের মূল্য ছিল চার আনা (১০ টাকা মণ)। একটি গভীর নলকূপের দাম ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা। সেটি কৃষক সমবায়কে দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট প্রদানের মাধ্যমে। প্রতি ইউনিট পাওয়ার পাম্পের দাম ছিল প্রায় ২২ হাজার টাকা। সেটি ভাড়ায় দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০০ টাকায়। আধুনিক বীজ সরবরাহ করা হয়েছে নামমাত্র মূল্যে। পোকার ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় বিনা মূল্যে। তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক্টর ও টিলার সরবরাহ করেন। তাতে  কৃষকদের উৎপাদন খরচ পড়ে কম। অন্যদিকে তিনি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেন। ধান, পাট, তামাক, আখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করে দেন। এভাবে তিনি কৃষির উৎপাদনকে লাভজনক করে তোলেন দেশের কৃষকদের জন্য।


১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সমাজে চাষীরা হলেন সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ তার এই অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে দেশের তৎকালীন বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের শরিকানা ছিল ২০ শতাংশ। তাঁর নেতৃত্বের প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ৩১ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেশের আর্থিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিবেচনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল কৃষি উন্নয়নের ওপর। এজন্য তিনি সর্বাগ্রে কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচি জোরদার করেন। খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে জয়দেবপুরের বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করেন। ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রতিষ্ঠিত এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে। তাছাড়া তিনি ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিষ্ঠিত করেন আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সরকারের কৃষি গবেষণা বিভাগকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠনের জন্য তিনিই উদ্যোগ নেন এবং এ কাজে ড. কাজী এম বদরুদ্দোজাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। তাছাড়া জাতীয় পর্যায়ে কৃষি গবেষণার সমন্বয় সাধন ও মান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এস ডি চৌধুরীকে নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে নির্বাহী চেয়ারম্যান) করে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। সেই সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে পুনর্গঠিত ও সম্প্রসারিত করেন। তিনি উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, তুলা উন্নয়ন বোর্ডসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণ সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য। তিনি মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বিদ্যমান কার্যক্রম ও অবকাঠামো সম্প্রসারিত করেন। মৎস্য ও পশুসম্পদের উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তাছাড়া দুগ্ধ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাকে তরান্বিত করার জন্য গড়ে তোলেন মিল্ক ভিটা। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষকদের মাঝে ১ লাখ হালের বলদ ও ৫০ হাজার গাভী সরবরাহ করেন ভর্তুকি মূল্যে। গরিব কৃষকদের মাঝে তিনি সহজ শর্তে ১০ কোটি টাকার ঋণ ও ৫ কোটি টাকার সমবায় ঋণ বিতরণ করেন। তাছাড়া কৃষির সব উপখাতে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৃষক পর্যায়ে তার সম্প্রসারণ এবং গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের জন্য তিনি বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।


কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। এরাই গবেষণা করবে এবং গবেষণার ফলাফল মাঠে পৌঁছে দেবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। সে কারণে কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ছুটে যান ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ভাষণ দেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের এক সমাবেশে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু দেশের অন্যান্য কারিগরি গ্র্যাজুয়েটদের (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার) অনুরূপ কৃষি গ্র্যাজুয়েটের চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা নিশ্চিত করেন। তাদেরকে টেকনিক্যাল গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ভাতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে তাতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কৃষিশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবেন। তিনি তাদের শিক্ষাজীবন শেষে মাঠে নেমে কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমাদের নজর গ্রামের দিকে দিতে হবে। কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের তিনি কৃষি বিপ্লব সফল করার আহ্বান জানান। কৃষি উন্নয়ন বলতে বঙ্গবন্ধু শস্য, মৎস্য, পশুপাখি ও বনসম্পদ অর্থাৎ সার্বিক কৃষি খাতের উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্য শুধু চাল, আটা নয়; মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারিও আছে।’ তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় আমাদের উর্বর জমি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, পশু-পাখি, মৎস্য, বনাঞ্চল ও পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছেন। এসবের ওপর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে তিনি খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের নিদের্শনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।’ এর সঙ্গে তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অভিঘাত সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।


বঙ্গবন্ধু আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকের দারিদ্র্য এবং জমির খণ্ডবিখণ্ডতাকে উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই তিনি কৃষি সমবায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার ভাবনা ছিল প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী কৃষি সমবায় গড়ে তোলা। তাতে আধুনিক চাষাবাদ হবে। সম্ভব হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষিপণ্যের বাজারজাত সম্ভব হবে। তাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যাবে। এর মাধ্যমে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক ও যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের কৃষকরা সব প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন। তাই তিনি সমবায়কে সংবিধানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে সমবায় মালিকানার স্পষ্টায়ন রয়েছে। দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য সমবায়কে হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সম্মেলনে ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষি গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে।.. কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল ভোগের ন্যায্য অধিকার।’


বঙ্গবন্ধু দেশের খাদ্য সংকট নিরসনের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে চেয়েছেন। আধুনিক কৃষি উপকরণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি একর জমির উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিন গুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিন গুণ করতে পারব না? ...যদি ডাবল ফসলও করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাল্লাহ হবে না।’


বঙ্গবন্ধু আজ নেই। তিনি লোকান্তরে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে সেই অভাব আর দৃষ্টিগোচর হয় না। দেশের কৃষি উৎপাদন ডাবল, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি হয়েছে। আমাদের এখন খাদ্য সংকট নেই। খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা এখন উদ্বৃত্ত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে কৃষি উন্নয়নের এক অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষকদের জন্য তিনি উদার সহায়তা দিচ্ছেন। সব দুর্যোগে ও দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। এ দেশের কৃষক এখন আর শোষিত ও বঞ্চিত নন। তারা সম্মানিত।

 

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা। উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৪২০৪৯১০

 

 


COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon